Skip to main content

রিধি'র গোলাপীতোয়ালে

ঢাকাকে সবাই দূর ছাই ভাল্লাগেনা শহর বলে সবসময় হৃদয়ের দূরত্বে রাখলেও, রিধি'র কাছে ঢাকে আপনই লাগে।
ওর কাছে মনে হয় হাজার হাজার মানুষের বুকে পুষে থাকার পরও, ঢাকা যেন রিধি'র মতোই ভীষণ নিঃসঙ্গ, একা, বাৎসল্যহীন। মেঘের মতো তাদের জীবনে আসে, জীবনরস আস্বাদন করে, তারপর আবার হাওয়ায় ভেসে চলে যায়।
মাঝখানে পরে থাকে কেবল কিছু অনাদর, অবহেলায় ফেলে যাওয়া বাক্সবন্দী স্মৃতি।

তবে এই যেমন রিধি বৃষ্টিতে কাদা প্যাচপ্যাচে, নর্দমার আবর্জনা উঠে আসা, গরমে চরমে ওঠা জীবন, ভীড়, রুক্ষ হবার পরও এই ঢাকাকে ভালোবাসে, তেমনি রিধির জীবনেও আছে কিছু ব্যতিক্রম।
সম্ভব এই ব্যতিক্রমগুলোই জীবনকে খানিকটা সহনীয় করে তোলে।
যদিও "কেন ওরা থেকে যায়?" এই প্রশ্ন বারবার করেও সে এর উত্তর পায়না, তবুও সে পুরোপুরি গ্রগণও করতে পারেনা।
একবার তার জীবনে জবরদস্তি ঘাঁটি গড়া এক বুনোফুলট বলেছিলো, "তুমি শূন্যতা বোঝো সই?"
রিধি ভ্রু কুঁচকে কতক্ষন ভাবার চেষ্টা করলো, তারপর কোনো কিছু কল্পনা করতে না পেরে জানালো "না!"
বুনোফুল হেসে বলেছিলো, "তা বুঝবে কিভাবে, তুমিতো কাউকে বুকের ভেতরে টানোনি কখনো। সবসময় নিরাপদ দূরত্বে রেখেছো!"

সেটা সত্যই তাই আসলে। তার জীবনে মেঘের মতো আসা যাওয়া মানুষের মাঝে যখন কোনো বুনোফুল, পাহাড়ি গাছ বা ঝিরি যখন ঘাঁটি গেড়ে বসে, সে তাদেরকে সবসময় নিরাপদ দূরত্বে রেখেছে যাতে তারা রিধি'র অভ্যাস হয়ে না যায়।
রিধি তেলাপোকা ভয় পায়না, স্যাপ-খোপ ভয় পায়না, ভয় পায় ভালোবাসতে।
কিন্তু সবসময় কি আর সে রক্ষে হয়। অনিয়ন্ত্রিত এই বস্তু গুঁড়ি মেরে হৃদয়ে মূল রোপন করে ফেলে টের পাওয়া যায়না।

রিধি যখন ময়লা, তৈলাক্ত, প্রায় কালো হয়ে যাওয়া গোলাপী তোয়ালেটা হাতে নিলো, তখন এক অদ্ভুত শূন্যতায় হঠাৎ পৃথিবীটা ভীষণ রংহীন মনে হলো। দু'গাল বেয়ে প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা তারপর অঝোরে অশ্রু নামলে রিধি আরো কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে যায়।
সে যুক্তি দিয়ে চেষ্টা করে এই অনাহূত কান্নার কারণকে।
এইতো একটা।
এমনতো কিছু নয়।
কত সুন্দর সুন্দর তোয়ালে পাওয়া যাবে আরো, এমনকি এটার থেকেও সুন্দর।
কিন্তু কোনো এক যুক্তিহীন কারণে কোনো যুক্তিই তার মনঃপুত হয়না, কান্নাও থামেনা।
সাড়ে তিন আনার একটা সাধের স্বর্ণের আংটি হারানোর পর যেখানে রিধি'র কেবল এক মুহূর্তের জন্য একটু মন খারাপ হবার পরেই সেটা ভুলে যায়, সেখানে এখানে তোয়ালের জন্য ঈদের দিন এমন হাপিস নয়নে কান্নার কোনো কারণ রিধি খুঁজে পেলোনা।

এক পাহাড়ি ঝিরি'র কাছ থেকে পেয়েছিলো সে তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। সাধারণতো ও এমন ছুঁচো স্বভাবের না। রিধি'র মা বলতো রিধি বাচ্চা হিসাবেও বেশ অচঞ্চল ছিল নাকি, কখনো খেলনা বা কোনো কিছু কিনতে চেয়ে জেড করেনি, যাতে বরং হাঁফ ছেড়ে না বেঁচে ওর মা বোধহয় একটু হতাশই ছিল। সে যেই বয়সেই থাক, কারো কাছেই কোনো আবদার রাখতোনা, এমনকি বাবার কাছেও না। মা'র না।
সেই রিধি হঠাৎ করে গিয়ে তাদের বাড়ির মেয়ের এগিয়ে তোয়ালে খানি দেখে সেটা ছুঁচো'র মতো চেয়ে বসলো, যদিও জানতো এটা মেহমানকে দেয়া কোনো নতুন তোয়ালে নয়।
কিন্তু তবুও কল্যাণীয়েষু এক বাক্যে বলে দিলেন, "পছন্দ হয়েছে নিয়ে নাও।"
রিধি বাড়ির মেয়েটির কথা ভেবে অনেক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলো, অপরাধবোধে ভুগেও যখন সে তোয়ালে খানি ফেরত দিতে চাইলো না, সে ছুঁচো হবারই সিদ্ধান্ত নিলো।

আসার সময় সেটাকে ধুয়ে মুছে ব্যাগের সবচেয়ে আরাম জায়গাটিতে তোয়ালেটি নিয়ে হাসতে হাসতে চলে আসে রিধি সেবার।
তারপর থেকে সে তোয়ালেটার কত যত্ন করে।
ব্যবহারতো করেইনা, কিছুদিন পরপর ভাঁজ খুলে ঘ্রান নেয়, আলতো করে মুখখানি মুছে, তারপর আবার কটকটে রোদে শুকিয়ে রেখে দেয়।
মাঝে মাঝে ঠান্ডা লাগলে রিধি তোয়ালেটাকে চাদরের মতো জড়িয়ে রাখে।
কখনো মন খারাপ হলে কিংবা ঘুম না এলে সে বালিশে দিয়ে রেখে তার উপর ঘুমায়, এতে সে সেদিন দুঃস্বপ্নও দেখেনা।

রিধি যখন বাড়ি ছেড়ে নিজের বাঁধতে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে বেড়ায় যাযাবরের মতো গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে টানাটানি করতে থাকে, তখন একবার সে তার কিছু জিনিস ওর মায়ের কাছে রেখে যায়।
সেখান থেকেই রিধি'র ছোটভাই যা করে, রিধি'র যে জিনিসটাই ওর চোখে লাগে সেটাই সে নিয়ে নেয়, বলার বা অনুমতি নেবার প্রযোজন মনে করেনা।
এই নিয়ে রিধি'র সাথে তার তুমুল কলহ হলেও, মায়ের পক্ষপাতের কারণে আর জিনিসটা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় এর কোনো সুরাহা হয়না।
এইসব নানানা কারণে রিধি খেয়ে না খেয়ে তার কুঁড়ে ঘরে পরে থাকে, ঝরে ভিজে, রোদে পুড়ে খেয়ে না খেয়ে সে চড়ুই পাখির মোট, কাঁচা ঘরেই খাস থাকে।

কিন্তু ঈদের সময় রিধি'র নানুর কথা খুব মনে পড়ে। তাই সেবারও রিধি ঈদের সময় যায় ওখানে।
যেয়েই সে আবিষ্কর করে তার বহু সাধের এ তোয়ালে খানি তার গুণধর ভাইটি ব্যবহার করে এমন অবস্থা করেছে যে প্রথমবার দেখে রিধি চিনতেই পারেনি।

রিধি ছিঁচকাঁদুনে নয়। তবুও সে সারা বিকেল হাপিস নয়নে কেঁদে, ঈদের আনন্দ মাটি করে ঘুমিয়ে গেলো। কান্নার কারণ না জানা থাকায় ও রিধি কিছুই না বলায় রিধি'র নানু খুব বিচলিত হয়ে ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো।

তারও অনেকদিন পর যখন কল্যাণীয়েষু আন্দামান থেকে ফোন করলো, রিধি খুব দুঃখ করে তাকে তার সাধের গোলাপী তোয়ালেখানি হারানোর কথা জানালো।
কল্যাণীয়েষু বুঝলোনা আসলে সে মুহূর্তে কিভাবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা উচিৎ, তাই সে কেবল শুনলোই, কোনো মন্তব্য করলোনা।
আর তার কিছুদিন পরেই ডাকে এলো একটি ছোট মোড়ক। রিধি কার কাছ থেকে কি এলো ভাবতে ভাবতে দেখে কল্যাণীয়েষুর থেকেই এসেছে।
সে সাথে সাহেই বুঝতে পারে এই মোড়কের ভেতরে কি থাকতে পারে।
এই তোয়ালে কি তার এতটা জুড়ে থাকবে যতটা তার গোলাপী তোয়ালেটি ছিল ?

IMG_20230806_003538.jpg

Comments

Popular posts from this blog

Music of Memories

  There are many songs, musical bands, and singers, which are related to certain memories and every time I listen or remember them, they remind me of those memories and times regardless of how old they are, they are still as vivid. Like, now after a long time, when I was listening to Linkin Park, it reminded me of the tender, precarious memories of my college days (11th&12th grade), plausibly the best memories of my academic life overall. Every song of Linkin Park reminds me of someone or something of those fragmented foregone days. When I was at the age of starting to learn about music appreciation, the world of music was rather very very concise and territorial in my country. I am referring to the time when broadband internet services were not available in our country yet and people would do a good business in just selling DVD, cassettes to music enthusiasts. Certainly, living in the suburbs of the city, in a culture where music is not much of a concern for daily life and not...

চৈত্রে সংক্রান্তি!

শর্টকার্ট বাজার আর চালু রান্নার চিন্তা নিয়ে বাজারে গেলেও, নজরকাড়া সবুজের কচি পুঁইশাকের টসটসে আঁটিটা দেখে পা যেন ওখানেই আটকে গেলো। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো। নতুন বাসায় আসার পর, কাঁচা বাজারে এখনো পা রাখা হয়নি। অবশেষে সারাদিন ঘুমিয়ে পেটে যখন ছুঁচোর কের্তন শুরু হলো, উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে, ঝিমাতে ঝিমাতে মানিব্যাগ হাতে নিয়ে গেঞ্জিটা গায়ে চাপিয়ে নীচে নামলাম। মাসের শুরু হলেও, মানিব্যাগের অবস্থা শোচনীয়। ভাবতে লাগলাম কি কেনা যায়, যাতে করে এই মাসে ৩/৪ বার রান্না করা যাবে এই এক বাজারেই। ভাবলাম মুরগী/গরুর মাংস নিয়ে নিব, ল্যাঠা চুকে যাবে। কিন্তু খুব সব্জিটব্জি খেতে ইচ্ছে করলো, সারা সপ্তাহ বিফ/চিকেন খেয়ে মুখে অরুচি চলে আসছে রিতীমতো। সারা মাসে ৩/৪ বার রহস্য হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে আমি একদিন রাঁধি, দুইদিন খাই। আর সাধারণত দিনে একবেলা খাই। এখন এই একবেলা খাই শুনে আপনার কল্পিত "ডায়েট"এর ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেননা। এটা আসলে রান্নার আলসেমির কারণে। সপ্তাহের ৫ দিন আপিসে লাঞ্চ দেয়, সাথে দেয় টুকটাক নাস্তা, আর যত মন চায় তত চা/কফি। রুটিন এমন হয়েছে যে, খাই কেবল যতক্ষন কাজের মাঝে থাকি। বাসায় ফিরে ঘুম, ঘুম থেক...

এই যে ক্ষণিকা শোনো...

  মানুষকে নিয়ে গল্প জুড়তে আমার জুড়ি নেই। মানে একেবারে যাকে বলে, বলা মাত্রই লিখে ফেলবো কিছু একটা। সাহিত্য অবশ্যি হবেনা কিন্তু গল্প হয় বৈকি। বিশেষ করে মানুষের প্রেম, জীবন, দর্শন নিয়ে আমার লিখতে বেশ লাগে। আমি দারুণ এক শ্রোতা। এত চমৎকার একটা আবহ দিয়ে যে দুদিনের পরিচয়ের মানুষও আমার কাছে তাদের গল্পের ঝুলি খুলে বসে যেটা হয়তো তাদের খুব আপন মানুষটিও জানেনা। যদিও পরবর্তীতে তাদেরকে সান্ত্বনা স্বরূপ বলা আমার নিখাঁদ সৎ মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, তবুও কেউ আমার কাছে এলে, কখনো "না" বলতে পারিনা। কথা বলতে না পেরে হাঁসফাঁস করা মানুষগুলোর জন্য আমার ভীষণ মায়া হয়। খুব কাছ থেকে মানুষের গল্প শুনলে বুঝা যায়, আমরা কত ক্ষুদ্র দর্শনকে জীবন ধরে নিয়ে দিনানিপাত করছি। যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়তাম হঠাৎ একবার খুব কবিতা লেখবার ঝুম ওঠে। আদপে কবিতাতো নয়, ওটাকে কোবতে বলাই শ্রেয়! ক্লাসে আমার কোনো নির্দিষ্ট সখা-সখী'র দল ছিলোনা অমনা। আমি ছিলাম সবার সাথী ধরণের। কেউ আমার জন্য বেঞ্চে জায়গা রাখবে, অন্যকে বসতে দেবেনা, আমার জন্য টিফিনের সময় অপেক্ষা করবে অমন বন্ধু বান্ধব আমার ছিলোনা। এতে বরং আমি বেশ আরামেই...