শর্টকার্ট বাজার আর চালু রান্নার চিন্তা নিয়ে বাজারে গেলেও, নজরকাড়া সবুজের কচি পুঁইশাকের টসটসে আঁটিটা দেখে পা যেন ওখানেই আটকে গেলো।
প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো।
নতুন বাসায় আসার পর, কাঁচা বাজারে এখনো পা রাখা হয়নি। অবশেষে সারাদিন ঘুমিয়ে পেটে যখন ছুঁচোর কের্তন শুরু হলো, উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে, ঝিমাতে ঝিমাতে মানিব্যাগ হাতে নিয়ে গেঞ্জিটা গায়ে চাপিয়ে নীচে নামলাম। মাসের শুরু হলেও, মানিব্যাগের অবস্থা শোচনীয়। ভাবতে লাগলাম কি কেনা যায়, যাতে করে এই মাসে ৩/৪ বার রান্না করা যাবে এই এক বাজারেই।
ভাবলাম মুরগী/গরুর মাংস নিয়ে নিব, ল্যাঠা চুকে যাবে। কিন্তু খুব সব্জিটব্জি খেতে ইচ্ছে করলো, সারা সপ্তাহ বিফ/চিকেন খেয়ে মুখে অরুচি চলে আসছে রিতীমতো।
সারা মাসে ৩/৪ বার রহস্য হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে আমি একদিন রাঁধি, দুইদিন খাই।
আর সাধারণত দিনে একবেলা খাই।
এখন এই একবেলা খাই শুনে আপনার কল্পিত "ডায়েট"এর ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেননা।
এটা আসলে রান্নার আলসেমির কারণে। সপ্তাহের ৫ দিন আপিসে লাঞ্চ দেয়, সাথে দেয় টুকটাক নাস্তা, আর যত মন চায় তত চা/কফি।
রুটিন এমন হয়েছে যে, খাই কেবল যতক্ষন কাজের মাঝে থাকি।
বাসায় ফিরে ঘুম, ঘুম থেকে উঠে আবার কাজে, এই যায় সপ্তাহের বাকি ৫ দিন।
আর সাপ্তাহিক ছুটিতে এসে অর্ধেক বেলা বিছানার সাথে লেপটেই কাটে। তারপর যখন পেটের বিদ্রোহ নেলসন মেন্ডেলার স্বরূপ ধারণ করে, তখন পরাজয় মেনে বিছানা ছেড়ে উঠতে হয়।
যেহেতু সপ্তাহে একদিন রান্না করি, সেজন্য এমন আড়ম্বর করে বাজারও করা যায়না আসলে।
আর ঠিক সেই কারণে প্রতি সপ্তাহে বাজার যাওয়াটাও একটা ঝামেলার কাজ।
এক অদ্ভুত প্যারাডক্সে আটকে আছি।
যেখানেই বাসা নিয়ে থেকেছি, আমার আশেপাশে সবার আমার সার্ভাইভাল গেম নিয়ে ভীষণ কৌতূহল! দরজা খুলে বের হলেই প্রথম প্রশ্ন থাকে, আপনি শেষ কখন খেয়েছেন?
আমার ধারনা আমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে তারা যতটা আগ্রহী তাদের প্রেমিকদের ক্ষেত্রেও অতটা না!
শুনতে হাস্যকর শোনালেও সত্যি বলতে কোনো কোনো সপ্তাহেতো, মাঝে মাঝে এদের সাথে অস্বস্তিকর মুহূর্ত এড়াতেই আসলে আমি রান্না করি, বাজারে যাবার ভান করি, ভান করি যেন আমি জীবন সংসার নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি।
এই ঢাকনার আড়ালে আমাকে নিয়ে তাদের যে বাকি কৌতূহল থাকে, তা থেকে একটু মুক্তি মেলে।
অবশ্য এ নিয়ে আমার কোনো বিরক্তি নেই তাদের প্রতি, মাঝে মধ্যে স্বগতোক্তি করলেও।
যাইহোক, তো কোথায় ছিলাম...?
ও হ্যা...বাজারে যাচ্ছিলাম।
তো সেই গভীর সবুজ টসটসে কচি পুঁইশাকের আঁটি দেখে আমি জায়গায় জমে গেলাম।
Source
শাক, মাছ, এবং যা কিছু জিনিস কাটকুটিতে একের বেশী ঝামেলা আছে, সেসব জিনিস আমি কদাপি কিনবোনা।
কেনা, কাটা, বাছা, রাঁধা সবটা হতে হবে সরলরৈখিক, এমন বাজার হবে, এবং সেক্ষেত্রে মাংস ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প আর থাকেনা আদপে, যদিও জিহ্বা লালায়িত থাকে শাকসবজির জন্য।
বাড়িতে গেলে বা নানুর বাড়ি গেলে, সবাই খুব হতাশ হয় এ জন্য। সবাই ভুনা মাংস, আলু দিয়ে গোশত, গোশত দিয়ে আলু, মাছের চচ্চড়ি, মাছের ভাজি, ডিমের কচুরি, পোলাও, রোস্ট, কোরমা নিয়ে বসে থাকে।
আর আমি যেয়ে খুঁজি পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, ঢেঁড়স ভাজি, করলা ভাজি ইত্যাদি ইত্যাদি।
চট্টগ্রামে রীতিমতো এটা সামাজিকভাবে মর্যাদাহানীর পর্যায়ে পড়ে।
আমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে, আগে থেকে বলে দেয়, "গরীবের মত খাবিনা! মাছ মাংস খাবি বেশী করে!"
মামীরা বলে "কি ভাই! তুমি আসার সুবাধে আমরা একটা জবরদস্ত মাছ গোশত রান্নার খাবার উছিলা পাই, সেই অধিকারও তুমি কেড়ে নিচ্ছ!"
এজন্য কোথাও বেড়াতে গেলে আমার বাসায় এসে আবার ভাত খেতে হয়।
আম্মাতো ভাত পাতে ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নাকাটিও শুরু করে, "আরে আমার বাছাটা! ভালো খাবার না খেতে খেতে ভালো খাবারে অরুচি চলে আসছে।"
আমি কাউকে বুঝাতে পারিনা, লাগাতার ডিম, মুরগী খেতে খেতে এখন শাকসবজিই আমার কাছে অমৃতো লাগে। এখন আস্তে আস্তে সবাই খানিকটা শান্তিচুক্তিতে এসেছে এই বিষয়ে।
এখন "তোর জন্য কলিজা রেখেছি, মুরগীর ঠ্যাং জমেছে কতগুলো কিংবা গরুর খাস গোশত পেয়েছি আজ ওটা রেখেছি" না শুনে শুনি "পাট শাক পেলাম খুব ভালো মানের, ওটা সিদ্ধ করে রেখেছি, আসলে রাঁধবো কিংবা টসটসে কচুর লতি অথবা কচুর শাকের গল্প"
ব্যাপারটা বাড়ি যাবার জন্য আলাদা আকুতি আনে।
আরে ধুর, কই থেকে কই চলে যাই।
তো বলছিলাম, আজকের প্রথম দেখায় প্রেমের কথা।
শাক কুটাবাছার ব্যাপারটা আমি কল্পনাই করতে চাইতাম না। কিন্তু এই শাকের আঁটিটা দেখে এই প্রেমকে এভাবেই যেতে দিতে মন চাইলো না।
"য়োলো"র থিওরিটা মনে একটু দোলা দিয়ে বলে যায় চুপিচুপি "কি আছে জীবনে, এগিয়ে যাও।"
আমিও দুরুদুরু বুকে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম,ও জয় করে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
আসার পথে বিজয়ীর মত সিনা উঁচিয়ে এসেছি, রাস্তায় সবাই একদম যাকে বলে, ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে চেয়েছে!
Comments
Post a Comment