আমি একজন সহকর্মীকে বলতে শুনেছি, "মেয়েরা কথা বলবে এবং তাদের মুখে মধু ঝরবে।"
কথায় আপত্তিকর কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবুও শুনে আমার ভ্রু কুঞ্চন আটকায়নি।
কেন?
এখানে একটা জাদু আছে।
দাবার ওপেনিংএর আমার একটা পছন্দের চাল হলো, Pawn-Chain'র তৈরী করা বিশেষ করে যদি আমি কালো নিয়ে খেলি।
এই চেইনের বৈশিষ্ট হলো, আপাত দৃষ্টিতে সৈন্যদের খুব একটা আমলে না নেয়া হলেও, আপনি যদি প্রতিপক্ষকে বেয়াড়া একটা পন-চেইন গড়তে দেন, এন্ড গেমে অথবা মিড্-গেমে আপনি একটা ফ্যাসাদে পড়বেন। এবং এটা ভাঙার জন্য আপনাকে ক্ষেত্রবিশেষে হাতি-ঘোড়া জাতীয় বড় কিছু স্যাক্রিফাইসও করতে হতে পারে।
এই যে, "মেয়েরা এমন" জাতীয় কতগুলা প্রথা, কথা মুখে মুখে ঘোরে, এই ছোট ছোটো শব্দগুলো আসলে একটা লম্বা ডিফেন্ডিং পন-চেইনের মতো।
এভাবেই একটা প্রথমে ধারণা , তারপর তথ্য, এবং পরে সেটা তত্ত্ব আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়।
কেন মেয়ে হলেই তাকে মিষ্টি হতে হবে, তার আপাতঃ অবস্থা সত্ত্বেও? হেসে হেসে কথা বলার ইচ্ছে সবার সাথে নাও হতে পারে?
সবসময় সে মেজাজ মর্জি নাও থাকতে পারে?
তাতে মহাভারত কেন অশুদ্ধ হবে?
একটা সূত্র কেন গড়ে উঠবে এই বিলাসী চাহিদার অপূর্ণতাকে ভিত্তি করে?
এ প্রশ্ন কেউ করে না।
আশাপূর্ণা দেবী সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর গ্রাম বাংলার কথা লিখে গেলেও, কি আশ্চর্য্য যে এই টুয়েন্টি-ফর্র্স্ট সেঞ্চুরিতে এসেও এখনো আশেপাশে তাকালেই সে সমাজ ব্যবস্থা চোখে পড়ে!
তখন একটা সময় ছিল যখন তালপাতায় লেখা পড়া হতো।
একেবারে ঠাঁটওয়ালা লোক না হলে কালী-দোয়াত বা বালির কাগজের চেহারাও দেখা যেত না। তখন গণ্য করা হতো, তালপাতা যেটা জনসাধারণের বিশেষত পুরুষদের লেখবার কাজে ব্যবহার হতো, তা স্পর্র্শ করাও নিষিদ্ধ মেয়েদের জন্য। মেয়েদের লেখা পড়া জানাটা পাপ বলেই পরিগণিত হতো।
ভয় দেখানোর শেষ স্তর হিসাবে বেছে নেয়া হয় কানা হয়ে যাওয়া।
কি অদ্ভুত, যে বস্তু না জানলে কানা সেটা জানার অপরাধে কানার দলে ফেলা হতো।
তা নেহাত মন্দ নয় বটে। তখন এমনও হয়েছে মেয়েরা স্বামীর চেহারা না দেখেই একটা সমগ্র জীবন তার সাথে কাটিয়ে দিয়েছে।
এমনকি স্ত্রীলোকদের ঘরে আর ঘোমটার আঁধারে থাকতে থাকতে এমন অবস্থা হয় যে, দিনের আলোয় নিজের স্ত্রীকে দেখে চিনতে পারতোনা পুরুষগুলো।
বেশি দূরে যাব কেন!
এই আমারে জ্ঞাতি গুষ্ঠিতেইতো আছে. আমার নানাবাড়ির ১৪ গুষ্ঠিতে আমার কাছাকাছি শিক্ষিত কেউ নেই।
এইরকম উদ্যাম, চঞ্চল একটা সময়ে, এখনো আমার আধেক বয়েসী বোনদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, গেছে। তাদের বাবাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আমার বাবার থেকেও সরেস হবার পরেও তাদের পড়তে দেয়া হয় না বা পড়েনা।
আবার এমনও আছে যে, আমাদের এই মেয়েদের কাছেই পড়াশুনা করাটা একটা বিড়ম্বনা লাগে।
যে খালাতো বোনকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি যখন আমি উচ্চমাধ্যমিকে সে খালাতো বোনের বিয়ে দিয়ে এলাম গত বছর, শুনলাম সন্তান হতেও বেশি দেরি নেই। আশ্চর্য হয়ে মা'কে বললাম, "সে কি। সে নিজেইত বাচ্চা। এখনই বাচ্চা নেবার এমন তোড়জোড় কেন?" মা বললো, "তার শশুড়বাড়ির লোকজনের ধারণা, সুন্দরী বৌ, তাকে জব্দ করে এই সংসারে বেঁধে রাখতে হবে নইলে যদি আবার ভেগে যায়। সে জন্য বাচ্চা নেওয়ায় তার পায়ে শেকল দেয়া হবে।"
আমি হাঁ রইলাম কতক্ষন।
অথচ এরা আমারই একান্ত আপন পরিবার।
আমার নানু দিনতারিণীর দেবী'র-ই যেন প্রেতাত্মা। আমার মামীদের মনে হয় সেইসব জ্ঞাতি খুড়ো, মাসি-পিসি যাদের কেবলই অস্তিত্বই আছে হাহাকার আর আকার দানে।
একেবারে খতিয়ে দেখলে আমার সাথে সত্যবতীর খুব একটা পার্র্থক্য দেখিনা। সমস্ত জঞ্জাল, গঞ্জনা ঠেলে এগোই একলাই। এমনকি মা'ও সেই ভুবনেশ্বরী, নিজে যা পায়নি, যা দেখেনি, যা ভাবেনি, সেই অবোধ্য, অস্পৃশ্য, অপরিণামদর্শন করার অস্পর্র্ধা করতে সে যেমন পারেনি বা পারবেনা, তথাপি আমাকেও করতে দেবেনা।
তবে এখানে রাম-কালীর জায়গায় বাবা না থাকলেও ছিল বাবার মা। তার ঠেলাঠেলিতেই আমার আটপৌরে জগৎ থেকে ভিন্ন জগতের সন্ধান মেলে। বাকিটাতে আর কারো সাধ্য ছিলোনা আমাকে থামায়।
অবশ্য বলা বাহুল্য নারীদের খোঁড়া করে রাখবার প্রায় সমস্ত দায় পুরুষ সমাজের সবাই বর্তালেও, এ অভিযোগ পুরপুরি অসত্য হবে। অনেক অনেক সেই উত্তরণের পিছেনেও ভূমিকা রেখেছে কোনো এক পুরুষ।
এটা সত্যি যে পুরুষদের তৈরী নিয়মতন্ত্রই শেকল পড়িয়েছে নারীকে, তবে নিজেদের উত্তরণের ব্যাপারে তাদেরও বোধকরি অতটা আগ্রহ ছিলোনা, নেই, থাকেনা। আমার আশেপাশেই কত দেখলাম, দেখছি সে নজির।
যে কালেই দেখা গেছে কালের ভারে দায়ী আমার চপলমতি কন্যারা, সব ছাপিয়ে হঠাৎ দূর্বিনীতা, তেজস্বিনীর ন্যায় জ্বলে উঠেছে, বাবা, ভাই, স্বামী, বন্ধু অথবা সমগোত্রীয় কাউকেই দেখা গেছে সে ইন্ধনের জোগাড়ে।
সে হৈমন্তীই বা বিলাসীই হোক , সত্যবতী কিংবা কুমুদিনী, অথবা এই আমি কিংবা তুমি।
মিসোজিনি আগে যেমন মরণ-পণ ছিল, এখনও তাই আছে। শকুনের মতো খুবলে খাওয়ার জন্য, ঈগলের মত শেন্য দৃষ্টি মেলে, হায়েনার মতো ওঁৎ পেতে... কেবল যুগের সাতে সংজ্ঞা আধুনিক হয়েছে বড়জোর।
ঘরে বাইরে যেখানে সবকিছুর দায় এক নারীর উপর চাপিয়ে ক্ষান্ত সমগ্র নারী সমাজ, নিজের গোত্রীয়কেই চাবিয়ে খেয়ে উল্লাস জ্ঞাপন করতে চায়, সেখানে সবকিছুর ভিড়ে কোনো এক পিতা, প্রপিতা, অথবা পতিই এগিয়ে বলেছে- "তুমি নিরপরাধ। তোমার জন্মটি আজন্ম পাপ হতে পারে কিন্তু তুমি নিরপরাধ। এ দায় তোমার নয়। তোমার উত্তরণই তোমার ধর্ম হোক।"
আমার উত্তরণ সম্পন্ন।খুলনা ইউনিভার্সিটি
খারাপ ভাগ্য বলে কিছু নেই, নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছু নেই।
ব্যাস!
Comments
Post a Comment