আমরা বাঙালিরা স্নেহের-দোহাই'কে এমন আতিশয্য দেবত্ব দান করেছি যে, সেটা প্রকাশ করবার সময় ছাতি দু'হাত ফুলিয়ে বলি যেন এক জন্মের অর্জন। তাতে অসুবিধে কোনো নেই।
আপনি স্নেহের আঁকড়িতে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন থাকুন।
কিন্তু অন্য কেউ দ্বিমত পোষণ করলেই সেটা বেদবাক্যের অবমাননা কেনো হবে!
আমি যখনই বলেছি এই অতিরঞ্জিত, মাত্রাহীন, নির্লজ্জ, স্বার্থপর, চতুর্মাত্রিক ভালবাসাটা আমার কাছে ভীষণ অসহনীয় লাগে,
সাথে সাথেই আবেগী লোকজন তেজোদ্দীপ্ত আবেগের আতিশয্যে হাঁহাঁহাঁ করে ছুটে এসে আমায় পাষাণী, হৃদয়হীনা, স্বার্থপর বলে তালিকাভুক্ত করে ফেলে! কিন্তু ভালবাসা অসুস্থ না হয়ে সুস্থও হয় হে সুজন। যদিও তা প্রায় "বিরল" তবে ডাইনোসরদের মত একেবারে লুপ্ত নয়!
আমি বিখ্যাত কিম্বা কুখ্যাত কেউ নই বলে ভবঘুরে জীবনের তাৎপর্য নিয়ে আমার অকাট্য যুক্তি বাকোয়াজ বলে উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা থাকে। আমি যদি Gibran Khalil এর দ্বারস্থ হয়ে তার থেকে ব্যাখ্যা করে, আতেঁল বলে কটাক্ষ শুনি। এদ্দিনে অবশেষে এক প্রাণের বান্ধব পেলাম যিনি কিনা একইসাথে খাপে-খাপ-মনসুরের-বাপ ধাঁচে পুরো ব্যাপারটা তরল বাংলায় বলে দিলেন, সাথে আবার তিনি অবিখ্যাতও নন!
সে হলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন আর তাঁর ভবঘুরে শাস্ত্র!
বলা বাহুল্য, প্রায় সব সময়, সব জায়গায়, সকলের কাছে পাওয়া নিত্যদিনের বিষম "অগ্রহণযোগ্যতা" আমাকে ভবঘুরে হবার থেকে নিরস্ত্র করতে পারেনি।
এখনো যে হঠাৎ হঠাৎ বন্ধনে আটকে যাবার এক দুর্নিবার লোভ মাথা চাড়া দেয়না তা নয়। এখনো যে স্নেহের আশ্রয়ে গুটিয়ে যাওয়া, ভালবাসার বাহুডোরে সেঁধিয়ে যাওয়া, সাফল্যের ঔজ্জ্বল্যে অন্ধ হয়ে যাওয়া... এ সবই অতর্কিতে এখনো হামলা চালায় বটে!
সর্বোপরি, আমিওতো এই আটপৌরে সমাজতান্ত্রিক সমাজ আমার এই মজ্জায় পুষেই বড় হয়েছি।
আমি ঠিক কবে, কোথায়, কখন উপলব্ধি করেছি জানিনা, তবে ইদানীং তিরিশের কোঠায় কড়া নাড়তে নাড়তে এখন বোধহয় আমার আর "সিঁদুর দিয়ে আঁচল তুলে প্রণাম করা" রমণী হয়ে ওঠা হলোনা।
আমি যে ভবঘুরে শাস্ত্র বেছে নিয়েছি, এ আমি মেনেও নিয়েছি। যদিও বলে রাখি বাঙালীয়ানার চৌকাঠের অন্তরালে বছরের পর বছর বেড়ে ওঠার (অ)কল্যাণে, ব্যাপারটা উপলব্ধি করা আর মেনে নেয়ার মাঝে বিস্তারিত ফারাক আছে।
তবে এখন যেহেতু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের সাড় দেবার লয় অনেক মন্থর, তাই সব "পর নির্ভরশীল" কাজেই সে অংক কষে। স্বাভাবিকভাবেই, হঠাৎ ঠেলে ওঠা সে আবেগের ধাবমান বেগকে যখন প্রাপ্তি আর বিসর্জনের অংকের ছাঁচে ফেলা হয়, ফলাফল যা আসে সে বন্ধনে আবদ্ধ হবার দুর্বার গতিকে লাগাম পরিয়ে দেয়।
তার মানে এই নয় যে যারা বন্ধন ভালোবেসে শেকড় গজিয়ে গাছের মত সমূলে গেঁড়ে গেছেন তারা কোনো শূদ্র গোত্রীয়!
আপনারা কিসে তুষ্ট সে আপনাদের হিসেব। আপনাদের সে মিলে যাওয়া অংকে যেমন ভবঘুরে হিসাবে মন্তব্য করা নিষ্প্রয়োজন মনে করি, তেমনি আমাদের মত ভবঘুরেদের অস্পৃশ্যা ঠাহর করাটা বাতুলতা বৈকি।
আমার যেহেতু আপনাদের কষ্ট-ভালবাসা, অশ্রদ্ধা-ভালবাসা, অবহেলা-ভালবাসা এবং সর্বোপরি অযৌক্তিক-ভালবাসা জাতীয় এক সম্পর্কে পরজীবির মত একে অন্যকে আঁকড়ে, আটকে বেঁচে থেকে সুখী হওয়ার প্রতি কোনো মন্তব্য নেই,
তেমনি আমারও ভবঘুরে হিসাবে
কেনো মনে হয় আপনি যেভাবে চান, আপনার সমাজ, ধর্ম, বর্ণ যেভাবে চায় আমাকে সেইটেই চাইতে হবে?
কোথাও পৌঁছুবার কোনো তাড়া নেই আমার।
তদুপরি আমি যা পেতে চাই এখন আমি নিজেই তা। সুতরাং আমার চাওয়ার আকাশ আরো বড়। এবং আমি জানি একসময় সেটাও আমি দখল করে নেবো।
প্রেমিক-প্রেমিকার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কে যেনো সেদিন বলছিল, মেয়েরা যেমন প্রেমিক চায় তারা নিজেরাই এখন সেটা হয়ে ওঠছে বলে প্রেমিক সমাজ এখন হাহাকারে আছে। আমার কেনো যেনো সত্যি মনে হলো কথাটা।
প্রেমিকের কাছে আমার "স্বাভাবিক" সঙ্গায় যা চাইবার, তার সবটা আমার অর্জন হয়ে গ্যাছে। আর পরবর্তীতে নতুন যে চাওয়া সেটা কারোর মাঝে পাওয়া যাচ্ছেনা। এখন পাওয়া যাচ্ছেনা বলেই কেউ একজনকে ধরে সংসার ফেঁদে বসাটার যৌক্তিকতা কেউ দিলোনা। অস্বীকার করি না পিছুটান। বরং পিছুটান সুখের হয় সেটার আষ্টেপৃষ্টে তিক্তের বাঁধনে না জড়িয়ে।
নিরাপদ অভ্যাস আর মিথোজীবীতায় না যেয়ে একছত্র স্বাধীনতার মাঝে একত্রে যাপিত জীবনের খোঁজে যাই।
পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই।
Comments
Post a Comment