Skip to main content

আমাদের চিঠিযুগ

তখনতো চিঠিযুগ। 
টেলিফোনের যে বিল বাব্বাহ!
আমাদের কড়া মধ্যবিত্ত সমাজে টেলিফোন ব্যবহার করা হতো শুধু কালেভদ্রে একটু প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য।
খোশ গল্প করবার কথা অচিন্তনীয়। 
খোশ গল্পের জন্য অবলম্বন কেবল চিঠিপত্র। 
মা'কে দেখতাম গোটাগোটা হরফে পাতায় পাতায় চিঠি লিখতো।
মনের কথা উজাড় করে ঢেলে দিত নিশ্চিন্তে, বিল বেড়ে যাচ্ছে এই দুশ্চিন্তা নেই।

সে কথা ঘুর্ণির জালে উত্তরবঙ্গ থেকে সুদূর দক্ষিণবঙ্গে পৌঁছাতে পৌঁছাতে খবর অনেক সময় লেগে যেতো।
চিঠিতে লেখা মা'র নতুন মুরগী'র বাচ্চাদের ডিমফুটে বেরুনোর আনন্দবার্তার সাধুবাদ ফিরতি পথে আসতে আসতে সেই মুরগির বাচ্চারা বড় হয়ে ডিম পাড়া শুরু করে দিত!
কিন্তু তাতে কি! 
এক প্রকার প্রমোদ তৃপ্তি কাজ করে যে অন্তত বার্তাতো পৌঁছেছে।
 যার কাছে পৌঁছেছে সে আগে হোক বা পরে, সে বার্তার ষোলোআনাই গ্রহণ করেছে।
চিঠি লেখার জন্য একটা আলাদাই আয়োজন থাকতো। মা চিঠি লিখতো আর আমাকেও শিখিয়ে শিখিয়ে দিত। 
ঠিক মনে নেই তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছি কিনা। 
মা'র পাশে পেটের উপর ভর দিয়ে উপুড় হয়ে আধ-শোয়া হয়ে, পা-জোড়া আকাশমুখী করে দুলিয়ে দুলিয়ে, পেন্সিল দিয়ে আমার প্রথম চিঠি লেখা।
আমাকে হাতের লেখা চর্চার করানো হতো কেবল চিঠি লেখানোর জন্য।

তখনকার সময়ে হাতের-লেখাকে পরীক্ষার নাম্বারের চেয়েও বেশী গুরুত্বের চোখে দেখা হতো।
বিশেষ করে আমাদের সময় নম্বরপত্রে  (Mark-sheet) অভিভাবকের স্বাক্ষর লাগতো। সেটা আবার পরদিন স্কুলে ক্লাসে সবাই সবাইকে দেখাতাম। 
কার অভিভাবকের সই কেমন সে নিয়ে আমাদের ভীষণ আগ্রহ আর গভীর আলোচনা বসতো।
আমার বাবা'র হাতের লেখা ভীষণ সুন্দর। 
আমি পরীক্ষার মার্কশিটে বাবার সই নেবার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।
পরীক্ষার নম্বরের থেকেও সেই সই বহু জরুরি। যেনো পরীক্ষার রেজাল্টের পর ওটা আমার পুরুষ্কার। 
আমি সে রাতে প্রচন্ড উতলা থাকতাম পরদিন স্কুলে যাবার জন্য। 
কারণ আমার বাবার স্বাক্ষরই সবথেকে সুন্দর আমার ক্লাসে।  
আমার খুব একচোট গর্ব হতো সবাই যখন দল বেঁধে দেখতো! 
এ নিয়ে মা'র বেশ কপট অভিমান আর অনুযোগও ছিল আমার প্রতি! 

বাবা, মা'র মত নিয়মিত চিঠি লিখতোনা। কালেভদ্রে লিখতো নানুর কাছে। 
নানুদের বাড়ির বড় জামাই হিসাবে বাবা'র আদর অনেক সেখানে।  আর চট্টগ্রামেতো বলাই বাহুল্য মেয়ে জামাইদেরকে রিতীমত অর্ঘ্যের উপর রাখা হয়।
বাবা যখন চিঠি লিখতে বসতো সেদিন আমার জন্য উৎসব।
বাবা মেঝেতে বেতের শীতল পাটি বিছিয়ে কোলে একটা বালিশ নিয়ে, পাশে চা'য়ের কাপ নিয়ে। 
আমি গালে হাত দিয়ে গভীর মনযোগে সে দক্ষ কলম চালনা দেখতাম।
তার মাঝে চলে আমাদের টুকটাক অর্থহীন আলাপ,বাবা'র বিবাহ-পূর্ব বোহেমিয়ান জীবনের রোমাঞ্চকর গল্প (যেটা আমার প্রিয় প্রসঙ্গ, এমনকি এখনো) মাঝেমধ্যে বেখেয়ালে দাদা-দাদীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, কদাচিৎ মা'র রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে যাওয়া। 
লেখা শেষে আমাকে পড়তেও দিত। 

তখনতো আর ভাষার দ্যোতনা বুঝতাম না। 
তবে বাবা, মা'র থেকে কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করতো। 
বাবা'র বাক্য গঠনও কেমন যেনো।
যেনো কোনো রাজার কাছে সুপারিশ পত্র পাঠাচ্ছে। 
মার্জিত লেখা, কোনো কাটাকুটি থাকবেনা সেখানে, ছোট ছোট কলিতে ভাগ করে লেখা।
যেনো চিঠিটাতেও বাড়ির-বড়-জামাই সুলভ ভারত্বের ছাপ রেখে যেতো।

আমার আজো চিঠির প্রতি এক অদ্ভুত প্রগাঢ় অনুরাগ এখনো হৃদয়ে লেপ্টে আছে। 
সম্ভবত মা-বাবা'র সাথে কাটানো সে চিঠিযুগের প্রতি অনুরক্তি থেকেই কিনা।
এমনকি এই যান্ত্রিক যুগেও আমি চিঠি খুঁজি।
আমার এই অনুরাগকে অনেকেই আহ্লাদিতও করে।

তাই আমাকে এখনো চিঠি লেখে আনন্দ। 

আমার প্রবল ঝক্কি-ঝামেলার, ব্যস্ততম যান্ত্রিক দিনের শেষে, সমুদ্রের পাড়ে বসে সে চিঠি পড়া, ঠিক জীবনানন্দের বনলতার মতই প্রশান্তি দিত আনন্দ'র চিঠি।

মাদুলির কথাও মনে পড়ছে আজ খুব।
কতদিন কথা হয়না।
সেই সুদূর ইংল্যান্ড, আমেরিকায় বাস করা ওরা; যারা জানেওনা, পোস্ট অফিস কি জিনিস বা আদৌ ওখানে পোস্টঅফিসের অস্তিত্ব আছে কিনা, ওরা আমাকে চিঠি দেয়ার চেষ্টা করে। 
এমনকি মাদুলির মত আলসে মেয়েও আমাকে ৩টে চিঠি লিখে সেগুলো পোস্টও করেছে আমেরিকা থেকে! 
যদিও দূর্ভাগ্যবশতঃ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে একটাও আমার কাছে আসেনি।

Comments

Popular posts from this blog

The portrait of a lady in fire and cold

  If you say my life is blend, it will not be presumed entirely wrong; however, not quite right either. If I must say, I have only started to live life when I was 25 years old, graduated, a fresh intern. Before that it's all hazy and blurry, not in a sense that I do not remember anything, but because I remember almost every pros of a bumping-stranger, but nowhere amidst that, I could find myself, as you are in your lucid dreams, a observer only. So if I am referring to a life or anything relevant to life, it's always from the age of 25. Hence, these 5 years of mine have been the time I lived. If I am to say, I lived as I pleased, that will not be incorrect. Of course, I had to be burdened with the responsibilities, criticism, denial and in terms of acquisition of an elderly child who belonged to any middle-class family; regardless, I was capable of living a life I have desired since my sense of life itself. With all these sacrifices, compromises I have chose to make with my own

চৈত্রে সংক্রান্তি!

শর্টকার্ট বাজার আর চালু রান্নার চিন্তা নিয়ে বাজারে গেলেও, নজরকাড়া সবুজের কচি পুঁইশাকের টসটসে আঁটিটা দেখে পা যেন ওখানেই আটকে গেলো। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো। নতুন বাসায় আসার পর, কাঁচা বাজারে এখনো পা রাখা হয়নি। অবশেষে সারাদিন ঘুমিয়ে পেটে যখন ছুঁচোর কের্তন শুরু হলো, উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে, ঝিমাতে ঝিমাতে মানিব্যাগ হাতে নিয়ে গেঞ্জিটা গায়ে চাপিয়ে নীচে নামলাম। মাসের শুরু হলেও, মানিব্যাগের অবস্থা শোচনীয়। ভাবতে লাগলাম কি কেনা যায়, যাতে করে এই মাসে ৩/৪ বার রান্না করা যাবে এই এক বাজারেই। ভাবলাম মুরগী/গরুর মাংস নিয়ে নিব, ল্যাঠা চুকে যাবে। কিন্তু খুব সব্জিটব্জি খেতে ইচ্ছে করলো, সারা সপ্তাহ বিফ/চিকেন খেয়ে মুখে অরুচি চলে আসছে রিতীমতো। সারা মাসে ৩/৪ বার রহস্য হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে আমি একদিন রাঁধি, দুইদিন খাই। আর সাধারণত দিনে একবেলা খাই। এখন এই একবেলা খাই শুনে আপনার কল্পিত "ডায়েট"এর ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেননা। এটা আসলে রান্নার আলসেমির কারণে। সপ্তাহের ৫ দিন আপিসে লাঞ্চ দেয়, সাথে দেয় টুকটাক নাস্তা, আর যত মন চায় তত চা/কফি। রুটিন এমন হয়েছে যে, খাই কেবল যতক্ষন কাজের মাঝে থাকি। বাসায় ফিরে ঘুম, ঘুম থেক

অপ্সৃশ্যা!

 দু'হাত পকেটে পুরে যখন রাস্তা পার হচ্ছো, গাড়ির স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে, তোমার বুড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো, ঠিক আলাদা করতে পারছিলাম! কপট অভিমানে আনমনে বললাম, "কতদিন নিজের যত্ন নাওনা!" কথা দিয়েছিলে, এক মুঠো জোনাকি ধরে ঘর আলো করে দেবে! তারপর কয়েকযুগ পেরিয়ে গেলো, তবুও তোমার জোনাকি ধরা হলোনা! এই মুহূর্তে চশমার কাঁচ মুছতে গিয়ে, ভেবে দেখলাম, সে অপেক্ষায় আছি আমি আজো! তোমার মনে পড়ে? সিঁদুরের কৌটো হাতে এসে বলেছিলাম, "আমার বেনারসি, চুড়ি-ফিতা কিচ্ছু চাইনা, সিঁদুর পরাবে আর বুকের মাঝে রাখবে। মাঝেমাঝে বাস্তবতার কাছে হেরে গেলে, অল্প করে নাহয় আক্ষেপও করবে।" তুমি হেসে বলেছিলে, " বোকা মেয়ে! শুধু ভালবাসা সস্তা, ওতে সংসার চলে না। যে তোমাকে রানী করে রাখতে পারবেনা, তোমাকে ছোঁবার অধিকার তার হবেনা। তুমি বরং সুখী হও! " আমি তোমার মুখপানে চেয়ে থেকে, কি যেনো খুঁজছিলাম দীর্ঘক্ষণ! চোখের পাতাটা কি কেঁপেছিল? গালের পেশীগুলো মেকি হাসির আড়ালে কি হঠাৎ আড়ষ্ট হয়েছিলো? ট্রাফিকের আড়ালে তুমি অদৃশ্য হয়ে গেলে, কিন্তু আমি তোমাকে ঠিক দেখেছি, আর সে মুহূর্তেই বুঝেছি, তুমি ভালো নেই। আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাক