বাংলা সাহিত্যে বহুল জনপ্রিয় কিছু বাক্যের মাঝে একটি হচ্ছে - কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিল, যে সে মরে নাই।
আমার জানামতে সাহিত্যে অবদান না রেখেও সাহিত্য সম্ভারে এতটা জনপ্রিয় অথবা চর্চিত আর কোন মানুষ হন নাই বোধহয়, এক কাদম্বরী ছাড়া!
কাদম্বরীর এতটা আলোচিত ও সমালোচিত হবার পেছনে কেবলই রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত সম্পর্কের অবদান কিনা সে তর্কও বহুলাংশে বিতর্কিত।
এ যাবতকালে যত লেখক কাদম্বরীকে উপজীব্য করে কিছু রচনা করেছে তার পুরোটার লাইম লাইটে ছিল কেবল তাদের বেনামী প্রণয়। কাদম্বরীকে একান্ত রবি'র করে ছাড়া আর কোথাও স্বতন্ত্রভাবে ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়না। যেনো রবি'র অনবদ্য সৃষ্ট একটি চরিত্রের মতই কাদম্বরী।
অস্ত্বিত্বে থেকেও নেই, রহস্যে ঘেরা যা সুলঝানোর অবকাশ নেই, দ্বান্দ্বিকতায় ভরা, অন্তর্দাহ সব মিলিয়ে ভেবে দেখলে কাদম্বরীকে রবীন্দ্রনাথের একটি প্রকট চরিত্রই মনে হয়।
একদিকের বিচারে আমার ভাবনাটা একেবারে ফেলনা নয়।
কারণ কাদম্বরী সে সুনীল কিংবা রঞ্জন অথবা মৈত্রেয়ী যাঁর সাহিত্যেই আসুক না কেনো,
সে কেবলই কাদম্বরী হিসাবে কম, রবি'র প্রেয়সী হিসাবেই বেশী প্রকট।
অথচ কাদম্বরীর অল্প বয়সেই জ্যোতির বৌ হয়ে আসার পর থেকে ও বাড়িতে বহু বছর ধরে বেড়ে ওঠার চিত্রটাও একেবারে আটপৌরে তাও না! সে সত্ত্বার গল্পও আমার ধারণা সেকালের দাগ কেটে যাওয়া কোনো নারীর চেয়ে কম হতোনা, তায় আবার কাদম্বরী যেখানে বাস্তব ফিকশন!
কাদম্বরীকে নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের "কাদম্বরী" সিনেমাটা দেখেছি।
সিনেমা বিচারে দেখলে সেটা বেশ ছিল। কিন্তু মূল উপজীব্য যেহেতু কাদম্বরী কেন্দ্রিক, সে দৃষ্টিকোণে খুব একটা ভালো লাগেনি। কাদম্বরীর সমগ্র যাপিত জীবনকে কেবলই রবি রবিময় করে ফেলাটাতে আমার ঘোর আপত্তি সবসময় অনুভব করেছি।
সে অনুভূতিটা প্রবল নাড়া খায় যখন জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়ি যেয়ে আবিষ্কার করলাম কাদম্বরীর অস্তিত্বকে বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবে "অস্বীকার" করা হয়েছে।
কাদম্বরীর যাপিত জীবন বা আত্মহত্যা সবটাকেই কেবলই রবি কেন্দ্রিক করে ফেলার সবার যে একটা প্রবণতা সেটাতে আমার বিশেষ আপত্তি আছে।
হ্যাঁ অস্বীকার করবার জো নেই, কল্পকথা বাদ দিলেও, আত্মহত্যায় রবির প্রতি যে অনুরাগ তারই প্রচ্ছন্ন সংযোগ অনস্বীকার্য, তবে কেবলই রবি বিবাহ করলো বা দূরে চলে গেলো বলে বিরহিণী প্রাণ দিয়া প্রণয়ের প্রমাণ দিল এ কথা একটু বেশীই রংচঙে।
কাদম্বরীর একান্ত নিজস্ব যে জীবন, তাওতো কম বৈচিত্র্যময় না!
কাদম্বরীর মত অল্পবয়স্কা এক খুবই সাধারণ কিশোরীর বলা নেই কওয়া নেই আচম্বিত এক কোলকাতার খ্যাতনামা পরিবারের মাঝে, কতগুলা তারও চেয়ে অসাধারণ মানুষের মাঝে পরিবারের অংশ হিসাবে এসে পড়া এবং তার মাঝে নিজস্ব প্রচেষ্টায় গড়ে, বেড়ে ওঠার যে গল্প; তার উপরেও অনেক নন-ফিকশন না হলেও নিদেনপক্ষে ফিকশনতো হতেই পারতো।
তার জীবনে জ্যোতি বা দেবেন্দ্র কিংবা উর্মিলারও প্রভাব ছিল। প্রভাব ছিল সাহিত্য সভার বিহারি লাল, এমনকি বিনোদীনির মত ক্ষীণজীবিরও।
তার সাথে কাদম্বরীর একান্ত নিজস্ব অন্তর্দাহ, একান্ত অন্তরায়, অস্বীকৃত আক্ষেপ, আর সূক্ষ হীনমন্যতা।
কোথায় যেন পড়েছিলাম এমন যে রবি ঠাকুর বলেছেন (যার সারমর্ম করলে দাঁড়ায়)-
"কাদম্বরী মরে গিয়েই ভালো হয়েছে! সুখি স্মৃতি হয়ে আছে। কবিতায়, ছন্দে বেঁচে আছে। যদি বেঁচে থাকতো তবে কাদা ছোঁড়াছুড়ি হতো!
Comments
Post a Comment