Skip to main content

বিসর্জন কাহনঃ জলচৌকি

 ঃ আজকে ধরণী বেশি তপ্ত। আজকে না যাই বাজারে।

ঃ একদম নখরা করবেনা এইবেলা বলে দিচ্ছি!
ঃ বিক্রি না করলে হয়না! আর ক’টা দিন অপেক্ষা করি। একটা চাকরি ঠিক জুটে যাবে।
ঃ ততদিন কী ঘাস খেয়ে থাকবো? বাড়িওয়ালা কে কাঁঠাল পাতা দিয়ে ভাড়া দিব? মাস্টারের পয়সা কোত্থেকে আসবে!

যাবার সময় হলে আমার এই অযাচিত আবদার আর পরম ধৈর্য্য নিয়ে তার জবাব দেয়া- এ আমাদের রোজকার ঘ্যানঘ্যান।
মেলা হচ্ছে। সেখানেই এ জিনিসখানা বিক্রির চেষ্টা চলছে। সাধারণত এ জিনিস কেনার জন্য যেসব ক্রেতা প্রয়োজন, তারা এসব মেলায় কদাচিৎ আসে!

গ্রীষ্মের এখন যৌবনকাল! ঠা ঠা রোদে চারিদিক চৌচির। সাধারণত আপনি বিক্রেতা হলে ৩ প্রজাতির ক্রেতার দেখা মিলবে।

১ম প্রজাতি খুবই দূর্লভ।
ইনারা আলেকজান্ডার-দ্যা-গ্রেট এর মতন। এলাম, দেখলাম, জয় করলাম ধরণের। আসেন জিনিস দেখেন, পছন্দ হলে কিনে নিয়ে চলে যান। এখন অব্দি অবশ্য ভাগ্য এমন সুপ্রসন্ন হয়নি এমন কোনো ক্রেতা পাবার।

২য় শ্রেনীর ক্রেতা যারা, তারা আমার মতো সৌখিন কিন্তু সাধ্যে তেমন কুলায় না গোছের।
তবুও সাধের কিছু দেখলে সাধ করতে মন চায় বড়। বহু দোলাচালে ভুগতে ভুগতে দুঃসাহসী হয়ে দাম করতে চলে আসে। আবার দামে বিক্রেতা ফিরিয়ে দিলে একটু দুঃখ পায় বটে, তবে মনে মনে খুশিই হয়!
অনেকটা দূর্যোধনের পাশার দানের মতো। হারলেও অসুবিধা নাই, জিতলেতো জিতেই গেলাম ধরনের।

ঃ কত দাম ভাই!
ঃ একদাম পাঁচশ।
ঃ তিনশ টাকা দিব, দেবে?
ঃ জ্বি না।
ঃ (দোনোমোনা করতে থাকে আরেকটু বাড়াবে কিনা) আচ্ছা যাও তিনশ পঞ্চাশ দেবো। দিয়ে দাও ভাই!
ঃ মাফ করো ভাই, জিনিস চারশতেও দেবোনা।

তাঁদের আর রা থাকেনা। নিজের মনকে “চেষ্টা করেছি কিন্তু কাজ হলোনা” জাতীয় বুঝ দিতে দিতে গন্তব্যে যাত্রা করে। ক্রেতার প্রস্থানের সাথে সাথেই আমার সংগী গজগজ করে ওঠে।

ঃ কি জ্বালা! তিনশ পঞ্চাশতো ঢের ভালো দাম! ত্যোমার এ জিনিস কেউ যে দয়া করে কিনে নিয়ে যাবে সেইত কপাল!
ঃ হু
ঃ হু আবার কি! দাম ছাড়ছোনা কেনো! এমন যক্ষের মত ধরেই যদি রাখবে তো বেচতে এনেছো কেনো!

আমি কিছু বলিনা। আমিতো জানি আমার চেয়ে কোনো অংশেই তার এক বিন্দু কম ইচ্ছা নেই এইটা বিক্রি না হবার। সেই হতাশা থেকেই আমি অতি শান্ত আর উনি অতি তিক্ত।
আমরা হয়তো হাজার দু’আ করে চলেছি মনে মনে যাতে বিক্রি না হয়। তাই হয়তো আসলেও হচ্ছেনা।

যাক! বলছি ক্রেতা প্রজাতির কথা। আর ইনারা হচ্ছেন ৩য় প্রজাতির ক্রেতা। সংখ্যায় এরাই বেশি আসে প্রতিদিন।

ঃ অ্যাই! এর দাম কতো!
ঃ একদাম পাঁচশ!
ঃ বলে কি! এ জিনিস বাজারে নতুন কিনলেইতো এত দাম পড়বেনা! আবার ব্যবহার হয়েছে কতদিন!
ঃ ব্যবহার হয়েছে কেবল মাসখানেক।
ঃ সেইতো! হয়েছেতো! বলো কম কত দেবে।
ঃ কম হবেনা।
ঃ (আশেপাশের অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে) আরে এ কি মগের মুল্লুক নাকি! যা ইচ্ছে দাম চাইবে? বলি দেশে কি কোনো নিয়ম নেই!
ঃ আপনি পোষালে কিনবেন, না পোষালে কিনবেন না। এত হৈহৈ করবেন না দয়া করে।
ঃ তো হৈহৈ করবোনা! একটু ভব্যতা রেখে দাম বলো। পঞ্চাশ টাকা দেবো, দিয়ে দাও।
ঃ এ দামে হবেনা। (রাগ সামলাতে কপালের শিরা দপদপ করছে)
ঃ আশ্চর্য দেবে না কেনো! যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে এরচে আর কত বেশী হতে পারে এ জিনিসের দাম?
ঃ চারশ নিরানব্বয়েও দেবোনা।

ক্রেতা গজগজ করতে করতে চলে যায়। প্রতিদিন গড়ে দশজন ক্রেতা এলে তার মাঝে এই ৩য় শ্রেণীর ক্রেতাই থাকে ৭/৮ জন!
এমনিতেই এমন সাধের, আহ্লাদের জিনিসটা বেচতে নিয়ে আমার প্রাণ আনচান করে সারাক্ষণ, তায় আবার এমন তেতো মুখ নিঃসৃত তারও বেশি তেতো বাক্যালাপে আমার মনঃকষ্ট বেড়ে যায় বহুগুণ।

হঠাৎ কেনো যেনো কর্ণের কথা মনে পড়ছে।
মনে পড়ছে সে সময়ের কথা, যখন হস্তিনাপুরে কিংবা পাঞ্চাল রাজ্যে অপমানিত হয়েছিলো শুধুমাত্র পরিচয় সূতপুত্র হিসাবে বলে। অঙ্গরাজের যখন অমন দুর্নিবার আক্রোশ, অপরাগতা অনুভূত হতো,
 তখন অজ্ঞাত কারণে সে সূর্যের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইতো যেন দেবরাজ স্বয়ং এসে তার সব আক্ষেপের, বৈষম্যের কিংবা অপারগতার প্রতিকার দেবেন।

AGSersztej.jpg

আমারও এই মুহুর্তে কর্ণের কথা মনে হয় আকাশের জ্বলজ্বলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে।
মেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে শীঘ্রই।
কিন্তু জিনিসটার কোনো গতি হচ্ছেনা। এটার গায়ে হাত বুলাতে গিয়ে মনের কোনে ঈষৎ খুশী অনুভূত হতেই মনে হয় টাকারও বড় দরকার।
বাস্তবতা কড়া নাড়লে অসহায় আর অপরাধবোধ দুটোই জেঁকে ধরে বেশ।

ঘামে জর্জরিত চিটচিটে কাপড়ে, রৌদ্রের তীব্র দাবদাহে আগুনের মত শরীর জ্বললেও সব উপেক্ষিত হয়ে, আমার সত্ত্বা জুড়ে অধিকার করে আছে যা, তা হলো বিসর্জনের গভীর মর্মবেদনা।

আমি উদাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকি!
শরীরের সব সিক্তরস শুকিয়ে গেলেও, চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া দু’ ফোঁটা জল একটুও কৃপা করলোনা।

Comments

Popular posts from this blog

The portrait of a lady in fire and cold

  If you say my life is blend, it will not be presumed entirely wrong; however, not quite right either. If I must say, I have only started to live life when I was 25 years old, graduated, a fresh intern. Before that it's all hazy and blurry, not in a sense that I do not remember anything, but because I remember almost every pros of a bumping-stranger, but nowhere amidst that, I could find myself, as you are in your lucid dreams, a observer only. So if I am referring to a life or anything relevant to life, it's always from the age of 25. Hence, these 5 years of mine have been the time I lived. If I am to say, I lived as I pleased, that will not be incorrect. Of course, I had to be burdened with the responsibilities, criticism, denial and in terms of acquisition of an elderly child who belonged to any middle-class family; regardless, I was capable of living a life I have desired since my sense of life itself. With all these sacrifices, compromises I have chose to make with my own

চৈত্রে সংক্রান্তি!

শর্টকার্ট বাজার আর চালু রান্নার চিন্তা নিয়ে বাজারে গেলেও, নজরকাড়া সবুজের কচি পুঁইশাকের টসটসে আঁটিটা দেখে পা যেন ওখানেই আটকে গেলো। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো। নতুন বাসায় আসার পর, কাঁচা বাজারে এখনো পা রাখা হয়নি। অবশেষে সারাদিন ঘুমিয়ে পেটে যখন ছুঁচোর কের্তন শুরু হলো, উঠে চোখেমুখে পানি দিয়ে, ঝিমাতে ঝিমাতে মানিব্যাগ হাতে নিয়ে গেঞ্জিটা গায়ে চাপিয়ে নীচে নামলাম। মাসের শুরু হলেও, মানিব্যাগের অবস্থা শোচনীয়। ভাবতে লাগলাম কি কেনা যায়, যাতে করে এই মাসে ৩/৪ বার রান্না করা যাবে এই এক বাজারেই। ভাবলাম মুরগী/গরুর মাংস নিয়ে নিব, ল্যাঠা চুকে যাবে। কিন্তু খুব সব্জিটব্জি খেতে ইচ্ছে করলো, সারা সপ্তাহ বিফ/চিকেন খেয়ে মুখে অরুচি চলে আসছে রিতীমতো। সারা মাসে ৩/৪ বার রহস্য হচ্ছে প্রতি সপ্তাহে আমি একদিন রাঁধি, দুইদিন খাই। আর সাধারণত দিনে একবেলা খাই। এখন এই একবেলা খাই শুনে আপনার কল্পিত "ডায়েট"এর ধারণাকে প্রশ্রয় দেবেননা। এটা আসলে রান্নার আলসেমির কারণে। সপ্তাহের ৫ দিন আপিসে লাঞ্চ দেয়, সাথে দেয় টুকটাক নাস্তা, আর যত মন চায় তত চা/কফি। রুটিন এমন হয়েছে যে, খাই কেবল যতক্ষন কাজের মাঝে থাকি। বাসায় ফিরে ঘুম, ঘুম থেক

অপ্সৃশ্যা!

 দু'হাত পকেটে পুরে যখন রাস্তা পার হচ্ছো, গাড়ির স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে, তোমার বুড়িয়ে যাওয়া চুলগুলো, ঠিক আলাদা করতে পারছিলাম! কপট অভিমানে আনমনে বললাম, "কতদিন নিজের যত্ন নাওনা!" কথা দিয়েছিলে, এক মুঠো জোনাকি ধরে ঘর আলো করে দেবে! তারপর কয়েকযুগ পেরিয়ে গেলো, তবুও তোমার জোনাকি ধরা হলোনা! এই মুহূর্তে চশমার কাঁচ মুছতে গিয়ে, ভেবে দেখলাম, সে অপেক্ষায় আছি আমি আজো! তোমার মনে পড়ে? সিঁদুরের কৌটো হাতে এসে বলেছিলাম, "আমার বেনারসি, চুড়ি-ফিতা কিচ্ছু চাইনা, সিঁদুর পরাবে আর বুকের মাঝে রাখবে। মাঝেমাঝে বাস্তবতার কাছে হেরে গেলে, অল্প করে নাহয় আক্ষেপও করবে।" তুমি হেসে বলেছিলে, " বোকা মেয়ে! শুধু ভালবাসা সস্তা, ওতে সংসার চলে না। যে তোমাকে রানী করে রাখতে পারবেনা, তোমাকে ছোঁবার অধিকার তার হবেনা। তুমি বরং সুখী হও! " আমি তোমার মুখপানে চেয়ে থেকে, কি যেনো খুঁজছিলাম দীর্ঘক্ষণ! চোখের পাতাটা কি কেঁপেছিল? গালের পেশীগুলো মেকি হাসির আড়ালে কি হঠাৎ আড়ষ্ট হয়েছিলো? ট্রাফিকের আড়ালে তুমি অদৃশ্য হয়ে গেলে, কিন্তু আমি তোমাকে ঠিক দেখেছি, আর সে মুহূর্তেই বুঝেছি, তুমি ভালো নেই। আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাক