এমন হয় যে জীবনের অনেক গুরুত্বপুর্ণ কিছু আপনি বেমালুম ভুলে যাবেন, কিন্তু ছোটো বেলার খুবই নগণ্য অনেক ঘটনা এমন এমনভাবে আপনার স্মৃতিতে নাড়া দিবে যে আপনি হতম্ভের হয়ে ভাববেন এ কোন অলৌকিক ক্ষমতা।
আমিও হঠাৎ এই দ্রুতগামী দূর পাল্লার বাসে বসে কওয়া নেই-বার্তা নেই, না কোনো প্রেমিকের স্মৃতিকাতরতা, না কোনো অনুক্ত অভিমান, না কোনো অব্যক্ত আবেগ!
আমার মনে পড়ছে, খুব ছোট্ট বেলায় দেখা আমার প্রথম ও একমাত্র চোরের কথা! মানে হয় এসবের!
শীতকাল। বয়স কত হবে, ৯/১০ বছর!
মাঝ রাত্তিরে পাড়ায় চোর ধরা পড়েছে শুনলাম। সেদিন বাবার সাথে ভয়ানক জেদ, কান্নাকাটি করে চোর দেখানোর জন্য একেবারে অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলাম সেই শীতের রাতে।
আর উত্তরবঙ্গের শীতের রাত বাপু!
আমার মনে পড়েনা তার আগে চোর নিয়ে আমার কী ভাবনা ছিল। কিন্তু চোর দেখতে কেমন হয় তা দেখার ভীষণ বায়না ধরে বসলাম। নিরুপায় বাবার রাজি হতেই হলো। আর বাবা একবার কিছুতে রায় দিয়েছেতো মা'র আর কোনো রা চলবেনা ওতে! সেই শীতের রাতে মা ভালোমত পেঁচিয়ে-পুঁচিয়ে দিলেন বাধ্য হয়ে।
চললাম চোর দেখতে।
সম্ভবত শীতের রাত বলে খুব একটা ভীড়-টিড় ছিলনা। এতদিন বাদে এসে আমার ঠিক মনে পড়ে না “চোর” বলতে আমি আসলে কি জাতীয় প্রাণীকে মনে করতাম।
কারণ, এটুকু স্মৃতিতে লেপ্টে আছে যে, খুঁটির সাথে বাঁধা, মাটিতে বসে থাকা চোরটি দেখতে অবিকল মানুষের মত হওয়ায় অবাক এবং বোধহয় একটু হতাশও হয়েছিলাম!
বহুবছর আগের ঘটনা।
চোরটার চেহারা মনে নাই। তবে পষ্ট মনে আছে পুরো চিত্রটি। এমনকি এখনো তার আকৃতি, এমনকি তার পোশাক পর্যন্ত মনে আছে! বিচ্ছিরিরকম হলেও, মনে আছে তার আহত, রক্তাক্ত হওয়া অবস্থাও।
অনেকেই দেখলাম মারধর করেছে। একজন মারতে গিয়ে হাতের নখও তুলে নিয়েছে। অবশ্য মারধোর সব আমরা আসার আগেই শেষ। তখন সবাই শলা পরামর্শ করছিল পুলিশের হাতে তুলে দেবে কিনা!
হঠাৎ করেই আমার পাতলা শার্ট যেটার মারধোরে প্রায় অব্যবহার্য অবস্থা আর কাছা দেয়া লুঙ্গী পরে শীতের রাতে মাটিতে বসা, দু'হাত খুঁটিতে বাঁধা "ভাই মাফ করে দেন, ভাই ছেড়ে দেন এবার" বলতে থাকা রক্তাক্ত লোকটার জন্য প্রচন্ড মায়া হলো আমার।
সে মায়াটা এমন ঠেলে বেরিয়ে এলো যে এখন মনে পড়লে হাসি পায়! কোনো প্রকার অগ্রীম সতর্কতা ছাড়াই রাতের নিস্তব্ধতা চিড়ে আমার ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়ায় বোধহয় বাকিদের সাথে চোর নিজেও চমকে উঠেছিলো!
এলাকার লোকজন বাবাকে বকা দিল আমাকে নিয়ে আসার জন্য। তার মাঝেও কিছু উৎসাহী জনতা চোরটিকে গুঁতোতে থাকে লাঠিসোটা দিয়ে।
ফেরার পথে রাস্তার মধ্যে বাবা জিজ্ঞেস করলো "ওমা! এত সাহস নিয়ে চোর দেখতে এসে এভাবে ভয় পেয়ে গেলে!"
আমি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে তুলতে মাথা ঝাঁকালাম...
"চ্চ..চ্চোর...চ্চোচ্ছে...ছেরে দাও! ওকে...যেতে দাও! মারো কেনো!" আমার কথা শুনে বাবা প্রচুর হাসলেন... "ওমা! ওতো চোর। অপরাধ করেছে, মার খাবেনা!?"
ঃ "ন্নন..ন্না..খাবেনা!" খুব জেদ খাটিয়ে বললাম।
ঃ "তো ধরো... উমম... তোমার লাল জুতো জোড়া কেউ চুরি করে নিয়ে চলে গেলো! সে চোরকে ধরতে পারলে কী করবে?"
চুপ করে ছিলাম। খুবই ভয়ানক প্রশ্ন। আমার লাল জুতো জোড়া নিয়ে চলে যাবে কেউ! সেতো ভাবাই যায়ন! প্রচন্ড রেগে যেতাম এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে মনে তবুও চোরকে ওভাবে মারার পক্ষে যেতে পারিনি।
Comments
Post a Comment